আজ ৬ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ছবি: চট্টগ্রামের জিপিওর সম্মুখে তিন শহিদের সমাধি

জিপিওতে যেন আজও প্রহরায় মুক্তিযুদ্ধের ৩ অখ্যাত শহিদ


তখন ১৯৭১ সাল। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য এদেশের মানুষকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারপর সারাদেশে অচলাবস্থা তৈরি হয়। দফায় দফায় কার্ফিউ দিচ্ছিলো পাকিস্তানি আর্মি।

মার্চ মাসের কথা। সঠিক করে তারিখটা জানাতে পারেননি আব্দুল খালেকের পরিবারের কেউই। খালেক তখন ছিলেন হাটহাজারীর ছিপাতলী গ্রামের নিজ বাড়িতে। ছুটি নিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। এরমধ্যে লেগেছে কার্ফিউ। কিন্তু দায়িত্ব পালনে সে ছিলো খুবই কড়া ধাঁচের মানুষ। তার উপর চাকরিটাও ছিলো নিরাপত্তা রক্ষীর। কার্ফিউ চলাকালে গ্রাম থেকে হেঁটে হেঁটে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। মিলিটারি বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক কষ্টে-সৃষ্টে পৌঁছুলেন তার কর্মস্থল কোতোয়ালির জেনারেল পোস্ট অফিসে (জিপিও)। সেখানে জানতে পেলেন ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অফিস কার্যক্রম বন্ধ থাকবে, তাই সবাইকে নিরাপদ গন্তব্যে চলে যেতে বলা হয়েছে। উপস্থিত ছিলেন তারা তিনজন (অপর দু’জন সিনিয়র পোস্টমাস্টার শহিদ মোহাম্মদ আমীর ও সহকারী পোস্টমাস্টার মমতাজ উদ্দিন আহম্মদ)। অফিসে তখন ট্রেজারী রয়েছে (মূল্যবান ডাক টিকেট, বিবিধ হিসাবের মুদ্রা)। তাছাড়া চলছিলো কার্ফিউ, কোথায় যাবেন তারা? ট্রেজারীটাও পাহারা দেয়ার প্রয়োজন। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোথাও না গিয়ে অফিসেই থাকবেন। ইতোমধ্যে মমতাজ তার পরিবারবর্গ রেখে এসেছিলেন কুমিল্লায়। একটা বাসা ছিলো তার চুনার গুদাম এলাকায়। সারাদিন অফিসে থেকে কোনো কোনো রাতে চলে যেতেন সেখানে। আবার কোনো রাতে অবস্থা বেগতিক ঠেকলে অফিসের কোথাও বিছানা পেতে শুয়ে পড়তেন। আর আমীর স্ত্রীকে নিয়ে তখন থাকতেন পোস্ট অফিসের রেস্ট হাউজে।

প্রতিদিন মূল ফটক বন্ধ করে দায়িত্ব পালন করতেন খালেক। রেডিওতে খবর শুনতেন, স্থানীয় বা কোনো পথচারীকে সড়ক দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলে ফটক থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন দেশের খোঁজ-খবর। অফিসে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে নানারকম দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমিয়েও পড়তেন তিনি। এভাবে কাটলো কয়েকদিন। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল বেলা ১২টার দিকে পাকিস্তানি আর্মিরা জিপিওর সামনে এসে সশস্ত্রাব¯’ায় খালেককে গেইট খুলতে বাধ্য করে। পোস্টমাস্টারকে খুঁজে তারা। পোস্টমাস্টার হন্তদন্ত বেরিয়ে আসলে মিলিটারিরা তাকে নিয়ে চলে যায়। তখন উৎকন্ঠার শেষ নেই খালেক ও মমতাজের। আমীরের জন্য অ¯ি’র হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তারা। অপেক্ষার অবসান ঘটলো কিছু সময় পর। আমীর ফিরলেন তবে তার সাথে ছিলো আর্মিরাও। এ দফায় তারা ঢুকে পাকড়াও করলো মমতাজ ও খালেককে। মিলিটারীরা প্রথমে মমতাজের কাছে ট্রেজারীর চাবি চাইলে সে জানালো তার কাছে সেটি নেই, এরপর খালেকের কাছে সেটি চাইলে সেও জানালো চাবি সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। তারপর মুহুর্মুহু বিকট গুলির আওয়াজ, নিস্তব্ধ হলো চারপাশ। আর্মিরাও ফিরে গেলো কোর্ট বিল্ডিংয়ে। এসময় লুঠে নিয়ে গেলো ট্রেজারী, তছনছ করলো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ; ফাইল।

ঘটনাটি ঘটার পর কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে তখন। রেস্ট হাউজ থেকে গুলির শব্দ শুনেছিলেন (ওইসময় গুলি-বোমার শব্দ প্রায়শই হতো) আমীরের স্ত্রী হাসনা আরা খানম। খানিক বাদে বের হয়ে দেখতে পেলেন জিপিও প্রাঙ্গনে রক্তাক্ত অব¯’ায় লুটিয়ে আছে আমীর। কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি, দেখলেন মমতাজ ও খালেকও গুলিবিদ্ধ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তাদের শরীরের জামা। কিন্তু তখনও দেহে প্রাণ ছিলো আমীরের। স্বামীর মাথা কোলে তুলে নিয়ে তাকে বাঁচানোর কথা ভাবছিলেন হাসনা। আমীরের রক্তে ভিজে গিয়েছিলো হাসনার শাড়ি। সেসময় কোর্ট বিল্ডিং থেকে পাকিস্তানি সেনারা হাসনাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। উপায়ন্তর না দেখে ভিতরের দিকে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যান তিনি এবং পরক্ষণে আবার ফিরে আসেন। তখন কোনোকিছু নিয়ে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই তার। একটাই চিন্তা ঘুরছিলো মাথায়, কীভাবে স্বামীকে বাঁচানো যায়? আশেপাশে কিংবা খানিকটা দূরে যাকে দেখতে পাচ্ছিলেন তাকেই অনুরোধ করছিলেন তার স্বামীর আহত দেহটা রেস্ট হাউজে পৌঁছে দিতে। কিন্তু সম্মুখের রাস্তায় ওইসময় খানিক পরপর মিলিটারীর গাড়ি চলাচল করছিল। তাদের ভয়ে কেউ হাসনার সাহায্যের জন্য এগুচ্ছিলো না। তৎকালে আলকরণ এলাকায় থাকতেন জিপিওর কর্মী (পিয়ন কিংবা গাড়ি চালক) নূর মোহাম্মদ। আর্মিদের হামলার ঘটনাটি জানতে পেরে জিপিওর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছিলো সে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমীরকে ভিতরে নিয়ে যেতে সমর্থ হলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি নূর মোহাম্মদ। রেস্ট হাউজের ভেতরে মিনিট দশেক পর মৃত্যু হয় আমীরের। ওইদিন রাতের অন্ধকারে নূর মোহাম্মদ ও তার ভাই দিল মোহাম্মদ মিলে শবদেহগুলোর গোসলকার্য সম্পন্ন করে রেস্ট হাউজের সামনেই (বর্তমান জিপিওর সম্মুখে) তাদের সমাহিত করেছেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এইসব শহিদদের জীবন বিত্তান্ত সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে। তবে পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি। খোঁজ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ এবং শহিদদের একটি তালিকা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ডাক বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেলের বিশেষ সার্কুলার নম্বর-৬ এর তালিকানুযায়ী তারা হলেন-পাহাড়তলীর সাব পোস্টমাস্টার মোয়াজ্জেম হোসেন তালুকদার, জিপিওর পোস্টম্যান মো. ফয়জুর রহমান, কাপ্তাইয়ের সাব পোস্টমাস্টার মোহাম্মদ হাফিজ উল্ল্যাহ, ফটিকছড়ির রানার মুন্সি মিয়া, বাড়বকুন্ডের পোস্টম্যান বজলুল গফুর, চাঁদপুরের ক্যাশ ওভারশিয়ার আবদুর রশিদ সরকার, ডাক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ইউডিসি মোহাম্মদ ইউসুফ, কুমিল্লার রানার আবদুর রহমান, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সাব পোস্ট মাস্টার ওমর আলী, কুমিল্লা হেড অফিসের পোস্টম্যান মোহাম্মদ মতিউর রহমান। সিলেট ডিভিশনের সাব পোস্টমাস্টার মো. ইলিয়াস আলী চৌধুরী, ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরির এসও মোহাম্মদ হামিদ মিয়া, শ্রীরামিশীর সাব পোস্ট মাস্টার সৈয়দ জহির উদ্দিন, পোস্টম্যান মো. শফিকুর রহমান। নোয়াখালী ডিভিশনের এসপিএম কাজী মোহাম্মদ আমিন উল্যাহ, এসপিএম আবদুর রাজ্জাক, পোস্টম্যান সফি উল্যাহ, পোস্টম্যান শ্রী নগেন্দ্র কুমার নাগ, পোস্টম্যান শ্রী যোগেশ^র ভৌমিক, রানার আবদুল করিম। লক্ষ্মীপুরের ক্যাশ ওভারশিয়ার সগীর উদ্দিন।

লেখক: সাংবাদিক


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর